সাক্ষাৎকার গ্রহণের পদ্ধতি
১. ভূমিকা: সাংবাদিকতায় সাক্ষাৎকারের গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা
সাংবাদিকতায় সাক্ষাৎকার গ্রহণ একটি অপরিহার্য প্রক্রিয়া। এটি কেবল তথ্য সংগ্রহের একটি মাধ্যম নয়, বরং সংবাদের মূল উপাদানগুলোকে জীবন্ত করে তোলার একটি শিল্প। একটি সংবাদ প্রতিবেদনকে বিশ্বাসযোগ্য, তথ্যবহুল এবং পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য সাক্ষাৎকারের গুরুত্ব অপরিসীম। সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে সাংবাদিকরা ঘটনার গভীরে প্রবেশ করতে পারেন, প্রাসঙ্গিক ব্যক্তিদের দৃষ্টিভঙ্গি জানতে পারেন এবং তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে পারেন।
সাক্ষাৎকার জনগণকে নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ধারণা দেয়, ঘটনার পেছনের কারণগুলো তুলে ধরে এবং বিভিন্ন পক্ষের মতামত জানার সুযোগ করে দেয়। বিশেষ করে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায়, সাক্ষাৎকার প্রায়শই লুকানো তথ্য উন্মোচন এবং গুরুত্বপূর্ণ সূত্র খুঁজে বের করার মূল চাবিকাঠি। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক বা সাংস্কৃতিক যেকোনো খবরের জন্যই সাক্ষাৎকার একটি প্রাথমিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে, যা সাংবাদিককে তার পেশাগত দায়িত্ব পালনে সহায়তা করে। তাই, একজন সফল সাংবাদিক হওয়ার জন্য কার্যকর সাক্ষাৎকার গ্রহণের কৌশল আয়ত্ত করা অত্যন্ত জরুরি।
২. সাক্ষাৎকার কী: সংজ্ঞা, ধরণ
সাক্ষাৎকার হলো একজন সাংবাদিক কর্তৃক তথ্য সংগ্রহের জন্য একজন বা একাধিক ব্যক্তির সাথে সরাসরি আলাপচারিতা। এটি কাঠামোগত বা অকাঠামোগত হতে পারে, এবং এর মূল উদ্দেশ্য হলো প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমে প্রাসঙ্গিক তথ্য, মতামত, অনুভূতি বা অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করা।
ক. সংজ্ঞা
সাক্ষাৎকার হলো প্রশ্ন ও উত্তরের একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে সাংবাদিক একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে তথ্য, দৃষ্টিভঙ্গি বা অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। এটি কেবল জিজ্ঞাসাবাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি পারস্পরিক কথোপকথন যা তথ্যের আদান-প্রদানের উপর গুরুত্ব দেয়।
খ. ধরণ
সাক্ষাৎকারের ধরন মূলত এর উদ্দেশ্য এবং বিষয়বস্তুর উপর নির্ভর করে। প্রধান কিছু ধরণ নিচে উল্লেখ করা হলো:
i. তথ্যভিত্তিক সাক্ষাৎকার (Informative Interview)
- উদ্দেশ্য: কোনো নির্দিষ্ট ঘটনা, পরিসংখ্যান, বা বিষয়ের উপর তথ্য সংগ্রহ করা। এখানে মূল লক্ষ্য হলো 'কী', 'কখন', 'কোথায়', 'কে' এবং 'কীভাবে' (5W1H) এর উত্তর খুঁজে বের করা।
- উদাহরণ: একটি নতুন সরকারি নীতি, একটি দুর্ঘটনার বিবরণ, বা একটি অর্থনৈতিক প্রতিবেদনের উপর বিশেষজ্ঞের মতামত নেওয়া।
ii. অনুসন্ধানী সাক্ষাৎকার (Investigative Interview)
- উদ্দেশ্য: কোনো অনিয়ম, দুর্নীতি, বা লুকানো সত্য উন্মোচন করা। এই ধরনের সাক্ষাৎকারে গভীর প্রশ্ন এবং তথ্য যাচাইয়ের উপর জোর দেওয়া হয়।
- উদাহরণ: একটি দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাৎকার, বা একটি অপরাধের পেছনের কারণ জানতে ভুক্তভোগীর সাথে কথা বলা।
iii. ব্যক্তিত্বভিত্তিক সাক্ষাৎকার (Profile-based Interview)
- উদ্দেশ্য: কোনো ব্যক্তি, বিশেষ করে সেলিব্রিটি, রাজনীতিবিদ বা সফল ব্যক্তির জীবন, কর্ম, চিন্তা-ভাবনা এবং ব্যক্তিত্বের উপর আলোকপাত করা।
- উদাহরণ: একজন লেখকের সাহিত্যিক জীবন, একজন বিজ্ঞানীর গবেষণা, বা একজন ক্রীড়াবিদের ব্যক্তিগত সংগ্রাম ও সাফল্যের গল্প।
iv. ভক্স পপ (Vox Pop - Voice of the People)
- উদ্দেশ্য: কোনো নির্দিষ্ট বিষয় বা ঘটনার উপর সাধারণ মানুষের তাৎক্ষণিক মতামত বা প্রতিক্রিয়া সংগ্রহ করা। এটি সমাজে জনমতের একটি স্ন্যাপশট দেয়।
- উদাহরণ: বাজেট ঘোষণার পর সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া, বা একটি নতুন আইন সম্পর্কে পথচারীদের মতামত।
v. ব্যাখ্যামূলক সাক্ষাৎকার (Explanatory Interview)
- উদ্দেশ্য: কোনো জটিল বিষয় বা ধারণাকে সহজভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য বিশেষজ্ঞের সহায়তা নেওয়া।
- উদাহরণ: জলবায়ু পরিবর্তন বা মুদ্রাস্ফীতির মতো জটিল অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে একজন অর্থনীতিবিদের সাক্ষাৎকার।
৩. সাক্ষাৎকার গ্রহণের প্রস্তুতি
একটি সফল সাক্ষাৎকারের ভিত্তি হলো পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রস্তুতি। প্রস্তুতি ছাড়া সাক্ষাৎকার অর্থহীন এবং অকার্যকর হতে পারে।
ক. গবেষণা (Research)
- বিষয়বস্তুর উপর গবেষণা: সাক্ষাৎকারের বিষয়বস্তু সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান অর্জন করা অপরিহার্য। ঘটনার প্রেক্ষাপট, সংশ্লিষ্ট পরিসংখ্যান এবং ঐতিহাসিক তথ্য সম্পর্কে জেনে রাখা উচিত।
- সাক্ষাৎকারদাতার উপর গবেষণা: সাক্ষাৎকারদাতার পটভূমি, পেশাগত অভিজ্ঞতা, পূর্ববর্তী বক্তব্য, এবং বিতর্কিত বিষয় সম্পর্কে জানতে হবে। এটি প্রশ্ন তৈরিতে এবং সাক্ষাৎকারদাতার মেজাজ বুঝতে সাহায্য করবে।
- প্রতিযোগিতামূলক সংবাদ বিশ্লেষণ: একই বিষয় নিয়ে অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে কী ধরনের খবর প্রকাশিত হয়েছে, তা বিশ্লেষণ করলে নতুন প্রশ্ন তৈরি করা এবং নিজের সংবাদকে আলাদা করে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়।
খ. প্রশ্ন তৈরি
- উদ্দেশ্য নির্ধারণ: সাক্ষাৎকারের মূল উদ্দেশ্য কী, তা স্পষ্ট করে নিন এবং সেই অনুযায়ী প্রশ্ন সাজান।
- প্রশ্নের খসড়া তৈরি: একটি প্রাথমিক প্রশ্নের তালিকা তৈরি করুন, যা সাক্ষাৎকারের দিকনির্দেশনা দেবে। তবে, এই তালিকাটি কঠোরভাবে অনুসরণ না করে প্রয়োজনে পরিবর্তন করার মানসিকতা রাখুন।
- গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন প্রথমে: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরি প্রশ্নগুলো প্রথমে রাখুন, কারণ সময়ের অভাবে হয়তো সব প্রশ্ন করা সম্ভব নাও হতে পারে।
- সংক্ষিপ্ত ও স্পষ্ট প্রশ্ন: প্রশ্নগুলো সংক্ষিপ্ত, স্পষ্ট এবং এক-কেন্দ্রীভূত হওয়া উচিত, যাতে সাক্ষাৎকারদাতা সহজেই বুঝতে পারেন।
গ. সাক্ষাৎকারদাতার প্রোফাইল বোঝা
- সাক্ষাৎকারদাতার পদমর্যাদা, তার ব্যস্ততা, তার মেজাজ এবং তিনি কতটা তথ্য দিতে ইচ্ছুক, তা আগে থেকে অনুমান করার চেষ্টা করুন।
- তার জ্ঞান বা দক্ষতার ক্ষেত্র সম্পর্কে সচেতন থাকুন, যাতে তার প্রাসঙ্গিক উত্তরগুলো সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়।
- কিছু সাক্ষাৎকারদাতা সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করেন, আবার কেউ কেউ বিস্তারিত আলোচনা পছন্দ করেন। এটি বোঝার চেষ্টা করুন।
ঘ. সরঞ্জাম প্রস্তুত রাখা (রেকর্ডার, নোটবুক ইত্যাদি)
- রেকর্ডার: একটি নির্ভরযোগ্য ডিজিটাল অডিও রেকর্ডার প্রস্তুত রাখুন এবং নিশ্চিত করুন যে এটি সঠিকভাবে কাজ করছে এবং ব্যাটারি চার্জ করা আছে। ব্যাকআপ হিসেবে একটি অতিরিক্ত রেকর্ডার বা মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারেন।
- নোটবুক ও কলম: রেকর্ডারের পাশাপাশি নোট নেওয়ার জন্য একটি নোটবুক ও একাধিক কলম রাখুন। গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট, তারিখ, নাম এবং পরিসংখ্যান দ্রুত নোট করার অভ্যাস করুন।
- প্রশ্নপত্র: তৈরি করা প্রশ্নপত্র হাতের কাছে রাখুন, যাতে প্রয়োজনে দ্রুত দেখে নিতে পারেন।
- পরিবেশ: যদি সম্ভব হয়, সাক্ষাৎকারের স্থান সম্পর্কে আগে থেকে ধারণা নিন এবং নিশ্চিত করুন যে পরিবেশ শান্ত ও শব্দহীন, যাতে রেকর্ডিংয়ে কোনো সমস্যা না হয়।
৪. প্রশ্ন করার কৌশল
সাক্ষাৎকার সফল করার জন্য প্রশ্ন করার সঠিক কৌশল জানা অত্যন্ত জরুরি। এটি কেবল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা নয়, বরং সাক্ষাৎকারদাতার কাছ থেকে সর্বোচ্চ প্রাসঙ্গিক তথ্য বের করে আনা।
ক. খোলা (open-ended) ও বন্ধ (close-ended) প্রশ্নের পার্থক্য
- খোলা প্রশ্ন (Open-ended Questions):
- বৈশিষ্ট্য: এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সাধারণত 'হ্যাঁ' বা 'না' তে দেওয়া যায় না। এগুলো সাক্ষাৎকারদাতাকে বিস্তারিতভাবে কথা বলার সুযোগ দেয়, যা গভীর তথ্য ও অনুভূতি প্রকাশে সহায়ক।
- উদাহরণ: "এই ঘটনার পেছনে মূল কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?" বা "আপনার অভিজ্ঞতাটি কেমন ছিল?"
- ব্যবহার: যখন আপনি বিস্তারিত তথ্য, ব্যক্তিগত মতামত বা অনুভূতির গভীরতা জানতে চান।
- বন্ধ প্রশ্ন (Close-ended Questions):
- বৈশিষ্ট্য: এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সাধারণত 'হ্যাঁ', 'না', বা একটি নির্দিষ্ট তথ্য (যেমন, তারিখ, সংখ্যা) দিয়ে দেওয়া যায়।
- উদাহরণ: "আপনি কি গতকাল উপস্থিত ছিলেন?" বা "ঘটনাটি কখন ঘটেছিল?"
- ব্যবহার: যখন আপনি দ্রুত নির্দিষ্ট তথ্য যাচাই করতে চান বা কোনো বিষয় নিশ্চিত করতে চান।
খ. অনুসন্ধানী প্রশ্ন তৈরি করা (Crafting Probing Questions)
অনুসন্ধানী প্রশ্ন হলো সেই প্রশ্ন যা সাক্ষাৎকারদাতার প্রাথমিক উত্তরের উপর ভিত্তি করে আরও গভীরে প্রবেশ করে।
- কীভাবে তৈরি করবেন:
- 'কেন' এবং 'কীভাবে' জিজ্ঞাসা করুন: প্রাথমিক তথ্যের বাইরে কারণ ও প্রক্রিয়া জানতে এই প্রশ্নগুলো জরুরি।
- উদাহরণ: "আপনি বললেন এটি একটি চ্যালেঞ্জ ছিল, কিন্তু ঠিক কী ধরনের চ্যালেঞ্জ?" বা "আপনি এই সিদ্ধান্তে কিভাবে পৌঁছালেন?"
- নীরবতা ব্যবহার করুন: অনেক সময় উত্তর দেওয়ার পর কিছুটা নীরবতা সাক্ষাৎকারদাতাকে আরও কথা বলতে উৎসাহিত করে।
- পুনরাবৃত্তি/স্পষ্টীকরণ: যদি কোনো উত্তর অস্পষ্ট হয়, তবে সেই অংশটি পুনরাবৃত্তি করে বা অন্যভাবে প্রশ্ন করে স্পষ্টীকরণ চাইতে পারেন।
গ. follow-up প্রশ্নের গুরুত্ব
ফলো-আপ প্রশ্ন হলো সাক্ষাৎকারের মূল চালিকাশক্তি। এগুলো প্রাথমিক প্রশ্ন থেকে প্রাপ্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয় এবং সাক্ষাৎকারের গুণগত মান বাড়ায়।
- গুরুত্ব:
- তথ্যের গভীরতা বৃদ্ধি করে।
- অস্পষ্টতা দূর করে।
- নতুন সূত্র বা তথ্য উন্মোচন করে।
- সাক্ষাৎকারদাতার বক্তব্যকে আরও বিস্তারিত এবং সুনির্দিষ্ট করে।
- উদাহরণ: "আপনি এই মাত্র যে পয়েন্টটি উল্লেখ করলেন, সে সম্পর্কে কি আপনি আরও কিছু বলতে পারবেন?" অথবা "আপনি কি এর কোনো নির্দিষ্ট উদাহরণ দিতে পারবেন?"
৫. সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময়কার আচরণ
সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় একজন সাংবাদিকের আচরণ পেশাদারিত্বের পরিচয় বহন করে এবং সাক্ষাৎকারের পরিবেশকে প্রভাবিত করে।
ক. সৌজন্যতা ও সম্মান
- সময়ানুবর্তিতা: সাক্ষাৎকারের নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হন। দেরিতে পৌঁছানো unprofessionalism এর লক্ষণ।
- পরিচয়: প্রথমে নিজের ও আপনার সংবাদমাধ্যমের পরিচয় দিন এবং সাক্ষাৎকারের উদ্দেশ্য স্পষ্ট করুন।
- ধন্যবাদ জ্ঞাপন: সাক্ষাৎকার শেষে সময় দেওয়ার জন্য সাক্ষাৎকারদাতাকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানান।
- সীমা লঙ্ঘন নয়: ব্যক্তিগত বা সংবেদনশীল প্রশ্ন করার সময় সাক্ষাৎকারদাতার সীমা ও স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন।
খ. মনোযোগ সহকারে শোনা
- সক্রিয় শ্রবণ (Active Listening): শুধু প্রশ্ন করেই ক্ষান্ত হবেন না। সাক্ষাৎকারদাতার প্রতিটি কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। এটি আপনাকে ফলো-আপ প্রশ্ন তৈরি করতে এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চিহ্নিত করতে সাহায্য করবে।
- বাধা না দেওয়া: সাক্ষাৎকারদাতাকে কথা বলার সময় বাধা দেবেন না। তার বক্তব্য শেষ করার সুযোগ দিন।
- নীরবতা মেনে চলা: কিছু সময় নীরবতা সাক্ষাৎকারদাতাকে আরও কিছু বলার সুযোগ করে দেয়, যা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উন্মোচন করতে পারে।
গ. চোখের যোগাযোগ, ভঙ্গি, দেহ ভাষা
- চোখের যোগাযোগ: সাক্ষাৎকারদাতার সাথে পরিমিত চোখের যোগাযোগ বজায় রাখুন। এটি আপনার মনোযোগ এবং শ্রদ্ধার প্রতিফলন।
- ভঙ্গি: শান্ত, আত্মবিশ্বাসী এবং পেশাদার ভঙ্গি বজায় রাখুন। ঝুঁকে বসা বা অস্থিরতা এড়িয়ে চলুন।
- দেহ ভাষা: আপনার দেহ ভাষা যেন ইতিবাচক হয়। হাত বাঁধা বা বিরক্তিকর অঙ্গভঙ্গি এড়িয়ে চলুন। আপনার অঙ্গভঙ্গি যেন সাক্ষাৎকারদাতাকে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে সাহায্য করে।
৬. সাক্ষাৎকার রেকর্ড ও নোট নেওয়ার কৌশল
সাক্ষাৎকার থেকে প্রাপ্ত তথ্য নির্ভুলভাবে সংরক্ষণের জন্য রেকর্ড করা এবং নোট নেওয়া উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ।
- রেকর্ড করা (Recording):
- অনুমতি গ্রহণ: সাক্ষাৎকার শুরু করার আগে অবশ্যই সাক্ষাৎকারদাতার রেকর্ড করার অনুমতি নিন।
- সরঞ্জাম পরীক্ষা: নিশ্চিত করুন রেকর্ডারটি সঠিকভাবে কাজ করছে, পর্যাপ্ত ব্যাটারি এবং স্টোরেজ আছে।
- পরিবেশের শব্দ: পরিবেশের অবাঞ্ছিত শব্দ এড়াতে চেষ্টা করুন।
- ব্যাকআপ: একটি মোবাইল ফোন বা অন্য কোনো যন্ত্রে ব্যাকআপ রেকর্ড রাখার ব্যবস্থা করুন।
- নোট নেওয়া (Note-taking):
- মূল পয়েন্ট: রেকর্ডারের উপর পুরোপুরি নির্ভর না করে গুরুত্বপূর্ণ নাম, তারিখ, পরিসংখ্যান এবং মূল ধারণাগুলো নোটবুকে লিখে রাখুন।
- সংক্ষিপ্ত রূপ: দ্রুত নোট নেওয়ার জন্য নিজের সংক্ষিপ্ত রূপ বা সংকেত ব্যবহার করুন।
- আচরণ: সাক্ষাৎকারদাতার দেহ ভাষা, মুখের অভিব্যক্তি বা কোনো বিশেষ আচরণ, যা রেকর্ডে ধরা পড়বে না, তা নোট করে রাখুন।
- কোড: গুরুত্বপূর্ণ উদ্ধৃতি বা বক্তব্যের পাশে চিহ্নিত করার জন্য একটি নির্দিষ্ট কোড ব্যবহার করুন।
- রেকর্ডিং নম্বর: প্রতিটি সাক্ষাৎকারের রেকর্ডিংয়ে একটি রেফারেন্স নম্বর দিন এবং সেটি নোটেও লিখে রাখুন, যাতে পরে খুঁজে পেতে সুবিধা হয়।
৭. সাক্ষাৎকার-ভিত্তিক প্রতিবেদন লেখার পদ্ধতি (সংক্ষিপ্তভাবে)
সাক্ষাৎকার থেকে প্রাপ্ত তথ্যকে একটি কার্যকর সংবাদ প্রতিবেদনে রূপান্তর করা একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
- ট্রান্সক্রিপশন (Transcription): রেকর্ডিং শুনে গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোর প্রতিলিপি তৈরি করুন। এটি তথ্যের নির্ভুলতা নিশ্চিত করে।
- মূল তথ্য চিহ্নিতকরণ: সাক্ষাৎকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, নতুন এবং প্রাসঙ্গিক তথ্যগুলো চিহ্নিত করুন।
- কাঠামো তৈরি: সংবাদের কাঠামোগত নিয়ম (যেমন, উল্টো পিরামিড) অনুসরণ করে লিড, বডি এবং উপসংহার সাজান।
- উদ্ধৃতি ব্যবহার: সাক্ষাৎকারদাতার সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতিগুলো ব্যবহার করুন। উদ্ধৃতিগুলো যেন সংবাদের মূল বার্তাকে সমর্থন করে।
- বিশ্লেষণ ও প্রেক্ষাপট: শুধু উদ্ধৃতি নয়, সংবাদের সাথে প্রাসঙ্গিক বিশ্লেষণ এবং প্রেক্ষাপট যোগ করুন, যা পাঠককে বিষয়টি আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করবে।
- সাংবাদিকের ভয়েস: আপনার নিজের ভয়েস এবং সাক্ষাৎকারদাতার ভয়েসের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখুন। সাক্ষাৎকারদাতার বক্তব্যকে নিজের ভাষায় ব্যাখ্যা করুন, কিন্তু তার মূল বক্তব্যকে বিকৃত করবেন না।
৮. ভুল যেগুলো এড়ানো উচিত
নবীন সাংবাদিকরা সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় কিছু সাধারণ ভুল করে থাকেন, যা এড়িয়ে চলা অপরিহার্য।
- পক্ষপাতমূলক প্রশ্ন (Biased Questions): নিজের ব্যক্তিগত মতামত বা পূর্বধারণা থেকে প্রশ্ন তৈরি করবেন না। এমন প্রশ্ন করবেন না যা সাক্ষাৎকারদাতাকে একটি নির্দিষ্ট উত্তর দিতে বাধ্য করে।
- সাক্ষাৎকারদাতাকে অপমান করা বা আক্রমণাত্মক হওয়া: সাক্ষাৎকারদাতার প্রতি অশালীন বা আক্রমণাত্মক হবেন না। বিতর্কিত বিষয়ে প্রশ্ন করলেও শালীনতা বজায় রাখুন। এটি সাক্ষাৎকারদাতার আস্থা হারানো এবং তথ্য প্রাপ্তি ব্যাহত করতে পারে।
- প্রশ্নের ওপর দখল হারানো: সাক্ষাৎকারের সময় বিষয়বস্তু থেকে সরে যাওয়া বা অপ্রাসঙ্গিক আলোচনায় মেতে ওঠা এড়িয়ে চলুন। মূল উদ্দেশ্যের উপর ফোকাস রাখুন এবং প্রয়োজনে সাক্ষাৎকারদাতাকে সযত্নে মূল বিষয়ে ফিরিয়ে আনুন।
- অপ্রস্তুত থাকা: গবেষণা বা প্রশ্নপত্র ছাড়া সাক্ষাৎকারে যাওয়া একটি বড় ভুল। এটি অদক্ষতার পরিচয় দেয় এবং মূল্যবান সময় নষ্ট করে।
- শুনতে ব্যর্থ হওয়া: শুধুমাত্র পরবর্তী প্রশ্ন কী হবে তা নিয়ে চিন্তা করে সাক্ষাৎকারদাতার কথা মনোযোগ দিয়ে না শোনা। এতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাতছাড়া হতে পারে।
- রেকর্ড করতে ভুলে যাওয়া/সঠিকভাবে রেকর্ড না করা: অনুমতি নেওয়া সত্ত্বেও রেকর্ড না করা বা রেকর্ডিংয়ে সমস্যা হওয়া একটি গুরুতর ভুল।
৯. বাস্তব উদাহরণ ও কেস স্টাডি
সাক্ষাৎকার পরিস্থিতি:
সম্প্রতি একটি শহরে নতুন একটি উড়ালপুল উদ্বোধন করা হয়েছে। স্থানীয় সাংবাদিক রিনা এই উড়ালপুলের প্রভাব নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করছেন। তিনি শহরের মেয়র এবং একজন স্থানীয় বাসিন্দা, যার দোকান উড়ালপুলের পাশে অবস্থিত, তাদের সাক্ষাৎকার নেবেন।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ প্রক্রিয়া:
- প্রস্তুতি:
- গবেষণা: রিনা উড়ালপুল নির্মাণের বাজেট, সময়সীমা, ট্র্যাফিকের উপর এর সম্ভাব্য প্রভাব এবং পূর্ববর্তী সমীক্ষা সম্পর্কে গবেষণা করলেন। মেয়রের পূর্ববর্তী বক্তব্য এবং স্থানীয় ব্যবসায়ীদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কেও জানলেন।
- প্রশ্ন তৈরি (মেয়র):
- "উড়ালপুলটি উদ্বোধনের পর শহরের যানজটের ওপর এর তাৎক্ষণিক প্রভাব কী দেখছেন?" (খোলা)
- "এই প্রকল্পের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?" (খোলা)
- "নির্মাণকালে যে বিলম্ব হয়েছিল, তার কারণ কী ছিল?" (অনুসন্ধানী)
- "উড়ালপুলের কারণে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণের জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে?" (অনুসন্ধানী)
- প্রশ্ন তৈরি (স্থানীয় ব্যবসায়ী):
- "উড়ালপুল নির্মাণের সময় আপনার ব্যবসার ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়েছিল?" (খোলা)
- "বর্তমানে আপনার ব্যবসার কী অবস্থা?" (খোলা)
- "আপনি কি মনে করেন উড়ালপুলটি শহরের যানজট কমাতে সাহায্য করেছে?" (খোলা)
- "ক্ষতিপূরণ বাবদ আপনি কি কোনো সহায়তা পেয়েছেন?" (বন্ধ)
- সরঞ্জাম: রিনা দুটি রেকর্ডার, নোটবুক এবং কলম প্রস্তুত রাখলেন।
- সাক্ষাৎকার গ্রহণ:
- মেয়রের সাথে: রিনা মেয়রের কাছে বিনয়ের সাথে তার পরিচয় ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করলেন। তিনি মনোযোগ দিয়ে মেয়রের প্রতিটি কথা শুনলেন এবং প্রশ্ন তালিকা অনুসরণ করে প্রাসঙ্গিক ফলো-আপ প্রশ্ন করলেন। যখন মেয়র একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে অস্পষ্ট উত্তর দিলেন, তখন রিনা আরও বিশদ ব্যাখ্যা চাইলেন। মেয়রের কথা শেষ হওয়ার পর ধন্যবাদ জানিয়ে সাক্ষাৎকার শেষ করলেন।
- ব্যবসায়ীর সাথে: রিনা সহানুভূতিশীল আচরণ করলেন। ব্যবসায়ী তার সমস্যাগুলো বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করার সুযোগ পেলেন। রিনা তার ব্যক্তিগত আবেগ এবং সমস্যার প্রতি সংবেদনশীল থেকে প্রশ্ন করলেন। তিনি নির্দিষ্ট তথ্য যাচাই করার জন্য বন্ধ প্রশ্ন ব্যবহার করলেন ("আপনি কত টাকার ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদন করেছেন?"), এবং তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার গভীরে প্রবেশ করার জন্য খোলা প্রশ্ন করলেন।
- ভুল এড়ানো: রিনা মেয়রকে পক্ষপাতমূলক প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকলেন এবং ব্যবসায়ীর প্রতি কোনো রকম সহানুভূতি না দেখিয়ে শুধু তথ্য সংগ্রহে মনোযোগ দিলেন। তিনি সবসময় মূল বিষয়ে ফোকাস বজায় রাখলেন।
ফলাফল: রিনা উভয় সাক্ষাৎকার থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হলেন, যা তার প্রতিবেদনে উড়ালপুলের ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিক তুলে ধরতে সাহায্য করল, এবং পাঠককে একটি ভারসাম্যপূর্ণ চিত্র দিল।
১০. উপসংহার: একটি সফল সাক্ষাৎকারের বৈশিষ্ট্য এবং একজন সাংবাদিকের দায়িত্ব
একটি সফল সাক্ষাৎকার কেবল তথ্য সংগ্রহের একটি ধাপ নয়, বরং এটি সাংবাদিক ও সাক্ষাৎকারদাতার মধ্যে একটি কার্যকর যোগাযোগ সেতু। এর মূল বৈশিষ্ট্যগুলো হলো নির্ভুলতা, প্রাসঙ্গিকতা, গভীরতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা। একজন দক্ষ সাংবাদিক এই বৈশিষ্ট্যগুলো নিশ্চিত করার জন্য প্রস্তুতি, প্রশ্ন করার কৌশল এবং আচরণের প্রতিটি ধাপে সচেষ্ট থাকেন।
সাংবাদিকের দায়িত্ব শুধু তথ্য সংগ্রহ করা নয়, বরং সংবেদনশীলতা, নিরপেক্ষতা এবং পেশাদারিত্বের সাথে তা উপস্থাপন করা। মনে রাখবেন, প্রতিটি সাক্ষাৎকারই একটি নতুন শেখার অভিজ্ঞতা। নিয়মিত অনুশীলন, আত্মসমালোচনা এবং শেখার আগ্রহ একজন সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার গ্রহণে আরও দক্ষ করে তুলবে। পরিশেষে, একটি সফল সাক্ষাৎকার কেবলমাত্র একটি ভালো সংবাদ তৈরির পথ প্রশস্ত করে না, বরং এটি সাংবাদিকতার নৈতিক ভিত্তিকেও মজবুত করে এবং সমাজে এর ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে।